
শুক্রবার দুপুর সোয়া ১টা। ঢাকা মেডিকেলের করোনা ইউনিট-২-এর (নতুন ভবন) সামনে অনেক মানুষ হাঁটাহাঁটি করছে। হঠাৎ একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে গেটের সামনে দাঁড়াল। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে থাকা রোগীর স্বজনদের মধ্যে অনেক ব্যস্ততা। মিনিটখানেকের মধ্যে কয়েকজনে ধরাধরি করে মধ্যবয়স্কা এক নারীকে নামিয়ে সামনে থাকা চেয়ারে বসালেন। সঙ্গে আসা ছেলে, মেয়ে, বেয়াই ও বেয়াইন প্রত্যেকের ভেতরেই উৎকণ্ঠা। কেউ দৌড়াচ্ছেন ভর্তি কাউন্টারের সামনে, আবার কেউ রোগীর ব্যবস্থাপত্র নিয়ে চিকিৎসকের কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। এভাবে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করার আগেই আধাঘণ্টা কেটে যায়।
এর মধ্যে হঠাৎ রোগীর অক্সিজেন লেভেল কমে অএলে শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জরুরি অক্সিজেন দেওয়ার কথা বলেন। একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারও এগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অক্সিজেন মাস্ক না থাকায় সিলিন্ডারটি লাগানো যায়নি। স্বজনদের একজন তাৎক্ষণিক অক্সিজেন মাস্ক আনতে ফার্মেসির দিকে দৌড়ে যান। কয়েক মিনিট পরে অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে ফিরে আসতে আসতে রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে যায়। যখন মাস্ক লাগানো হয়, তখন শরীর একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সাড়া-শব্দও বন্ধ হয়ে যায়। অবস্থা আঁচ করতে পারলে সঙ্গে থাকা ছেলেমেয়েসহ উপস্থিত স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। স্বজনদের অভিযোগ, শুধু ভর্তি করাতেই আধাঘণ্টার বেশি সময় লাগায় বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালের গেটেই মারা যান ওই নারী।
জানা যায়, ভুক্তভোগী ওই নারীর নাম মালেকা বেগম (৪৭)। গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। করোনার উপসর্গ নিয়ে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যান। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠালে দুপুরের দিকে করোনা ইউনিট-২-এর সামনে আসেন তারা। কিন্তু চিকিৎসা তো দূরে থাকা, ভর্তি পর্যন্ত করাতে পারেননি। আধাঘণ্টার বেশি বাইরে অপেক্ষা করতে করতে চোখের সামনে মারা যান মালেকা। তারা বলেন, সরকার বলছে, হাসপাতালগুলোতে বেড ফাঁকা রয়েছে। অথচ রোগী নিয়ে এলে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাদের অভিযোগ, যদি বেড ফাঁকাই থাকে তা হলে ভর্তির কাজ শেষ করতে এত সময় লাগল কেন? এভাবে অবহেলার কারণে অনেক রোগী মারা যায় বলে তারা অভিযোগ করেন।
মেয়ে রোজিনা বেগম জানান, তার মা বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ। শুক্রবার সকালে অ্যাম্বুলেন্সে করে নরসিংদী থেকে ঢাকায় আসেন। প্রথমে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যান। কিন্তু সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠালে দুপুরের দিকে তারা ঢামেকের করোনা ইউনিট-২-এর সামনে আসেন। তিনি বলেন, আধাঘণ্টার বেশি সময় অপেক্ষা করলেও ভর্তির কাজ শেষ করতে পারেননি। অক্সিজেনের অভাবে বিনা চিকিৎসায় চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু দেখতে হলো।
সঙ্গে থাকা বেয়াই বলেন, ভর্তি কাউন্টারে গিয়ে রোগীর সঙ্কটাপন্ন অবস্থার কথা জানালে তারা আরও উল্টো ধমকি দেয়। কাউন্টারের লোকজন বলেন, ‘রোগীর অবস্থা খারাপ হলে আমাদের কী করার? বাইরে কয়েকজন রোগী বসে আছে, দেখেন না?।’ তিনি আরও বলেন, মানুষ জীবিত থাকা অবস্থায় কোনো গুরুত্ব দিল না, মারা যাওয়ার পর এসে অক্সিজেন লাগানো হয়।
যদিও অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করে এত সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়নি বলে দাবি করেছে করোনা ওয়ার্ড-সংশ্লিষ্টরা। তবে বেশ কয়েকজন রোগীর স্বজনকে অল্প সময়ের ভর্তির কাজ শেষ করতে দেখা গেছে।
হাসপাতাল-সংশ্লিষ্টরা বলেন, মার্চে করোনা রোগীদের অনেক চাপ থাকলেও এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে চাপ কমতে শুরু করেছে। তারা বলেন, মার্চের মাঝামাঝি সময়ে এত রোগীর চাপ ছিল যে, সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। নির্ধারিত শয্যার চেয়ে অতিরিক্ত রোগী হওয়ায় চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। প্রতিদিন অনেক রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। এ ছাড়া একটি আইসিইউ শয্যার জন্য অনেক হাসপাতালে ঘোরাঘুরির পরও ফিরে যেতে হয়েছে। অথচ বর্তমানে সাধারণ শয্যা যেমন ফাঁকা তেমনি অনেক হাসপাতালে আইসিইউ শয্যাও ফাঁকা পড়ে আছে।
ঢামেকের করোনা ইউনিট-২-এর ওয়ার্ডমাস্টার রিয়াজ জানান, শুক্রবার দুপুর ২টা পর্যন্ত ১০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া বিকাল পর্যন্ত ১৫-১৬ জনের মতো রোগী ভর্তি হয়েছে। তিনি বলেন, করোনা ইউনিট-২-এ অনেক সিট ফাঁকা আছে। তবে ইউনিটটিতে কোনো আইসিইউ বেড নেই। বেশ কিছুদিন আগে আগুনের ঘটনায় এ ইউনিটের আইসিইউ ইউনিট পুড়ে যাওয়ায় আর সংস্কার করা হয়নি।
সরেজমিন দেখা গেছে, দুপুরে দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আব্দুর রহমান (৪২) নামে এক রোগীকে নিয়ে আসা হয়। মাথায় হাড়ের সমস্যা নিয়ে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দুদিন পর সেখানে পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ এলে তাকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়। মামুন হোসেন (২৮) আরেক রোগীও আসে দুপুরের দিকে। তিনদিন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন মামুন। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করলে শুক্রবার ঢামেকে এসে ভর্তি হন। নাহিদা বেগম (৫০) আরও এক নারী আসেন ধামরাই থেকে। তার করোনা পজিটিভ ও অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ায় তাকে পুরনো বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়।
এদিকে মতিউর রহমান সরদার (৭৯) নামে এক রোগীকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যেতে দেখা গেছে। ঢাকা মেডিকেলে ১৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। মতিউর বলেন, সরকারি হাসপাতালে মানুষের ততবেশি প্রত্যাশা থাকে না। তবে যেটুকু থাকে সে অনুযায়ী চিকিৎসা ভালো ছিল।
ঢামেকের সামনে অ্যাম্বুলেন্স চালক আশরাফ বলেন, এপ্রিলের শুরুর দিকে হাসপাতালগুলোতে অনেক চেষ্টা করেও সিট মিলত না। বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে অনেক কষ্টে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি সিটের ব্যবস্থা করতে হতো। তবে মাসের শেষের দিকে এখন খুব সহজে সিট পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেলে আইসিইউ পাওয়া এখন আগের মতোই কষ্ট বলে তিনি জানান।
অবহেলার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদের মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি কল ধরেননি।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, কোনো গুরুতর রোগী নিয়ে এলে মারা যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তবে ভর্তি প্রক্রিয়ায় কারও বিলম্বের অবহেলা থাকলে খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, রোগীর স্বজনরা বিস্তারিত অভিযোগ করলে প্রকৃত ঘটনা জেনে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যে জানা গেছে, দেশের ৮ বিভাগে বর্তমানে মোট কোভিড ডেডিকেটেড শয্যাসংখ্যা ১২ হাজার ৩৬৫টি এবং মোট আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ১ হাজার ৮৪টি। এর মধ্যে শুক্রবার পর্যন্ত মোট ৮ হাজার ৩৩৫টি কোভিড জেনারেল বেড এবং ৪৫৯টি কোভিড আইসিইউ বেড খালি ছিল। আবার আট বিভাগের মধ্যে ঢাকা মহানগর হাসপাতালগুলোতে থাকা মোট ৫৬৪৪টি সাধারণ বেডের মধ্যে খালি ছিল ৩৪১৩টি ও মোট ৭৬৯টি আইসিইউ বেডের মধ্যে খালি ছিল ৩২৮টি। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৭০৫টি বেডের মধ্যে খালি ছিল ২৪৫টি। তবে ২০টি আইসিইউ বেডের মধ্যে কোনোটি খালি ছিল না।