
নকীব মাহমুদ, ঢাকা:
গত বছর বয়স্ক ও বেশি বয়সের ব্যক্তিরাই করোনায় বেশি মারা গেছে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে তরুণারাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন এবং তারা মারাও যাচ্ছেন। গত কয়েকদিনের পরিসংখ্যান তাই বলছে। তবে এই মৃত্যুর তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। সর্বশেষ মারা যান ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সানিয়া আক্তার। তিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। বুধবার মারা যান
৩০ বছর বয়সি সানিয়া সাত মাসের অন্তঃস্বত্তা ছিলেন। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। সোমবার তরুণ লেখক-প্রকাশক সার্জিল খান মাত্র ২৭ বছর বয়সে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
আগে বেশিরভাগ করোনায় আক্রান্ত ও মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে অধিকাংশের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি। অনেকের শরীরে কিডনি, হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা ও ডায়াবেটিক রোগ ছিল।
কিন্তু ভারতীয় (ডেল্টা) ভ্যারিয়েন্টে অন্য কোনো জটিলতা ছাড়াই তরুণের মৃত্যুর ঘটনা বেশি দেখা যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপে করোনা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে সর্দি-জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ উপেক্ষা করছে। তাদের মধ্যে করোনা পরীক্ষায় চরম অনীহা দেখা যাচ্ছে। শেষ সময়ে হাসপাতালে নিয়ে আসছে, যখন চিকিৎসকের পক্ষে আর করার কিছু থাকছে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার করোনায় আরও ২৩৯ জন মারা গেছে। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৫৫ জন মারা গেছে যাদের বয়স ২১ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে। ৬৫ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি, ৪৩ জনের বয়স ৭১ বছরের বেশি, ১৪ জনের বয়স ৮১ বছরের বেশি এবং একজনের বয়স ছিল ৯১ বছরের বেশি। শিশু-কিশোর বয়সি (০-২০ বছর) ৪ জন করোনায় মারা গেছে। এখন পর্যন্ত প্রাণঘাতী এই ভাইরাস ২০ হাজার ২৫৫ জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। নতুন করে ১৫ হাজার ২৭১ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
এ নিয়ে দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১২ লাখ ২৬ হাজার ২৫৩ জনে পৌঁছেছে। এতদিন সংক্রমণ ও মৃত্যু পুরুষের বেশি দেখা যেত। এই চিত্রেও বদল এসেছে। করোনায় আক্রান্ত ও সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে নারী মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ২৪ ঘণ্টায় যারা মারা গেছে, তাদের মধ্যে নারী পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। ১২৩ জন পুরুষ আর ২১৬ নারী মারা গেছে। এখন পর্যন্ত ৬৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ পুরুষ মারা গেছে। যেখানে নারীর মৃত্যুর হার ৩২ দশমিক ১২ শতাংশ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইডিসিআর) বলছে, বর্তমানে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৬৯ শতাংশই তরুণ-মধ্যবয়সি।
দেশে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ইউকে ভ্যারিয়েন্ট এবং সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের কারণেই এমনটি হচ্ছে। আগে ১ জন থেকে ১০ জন সংক্রমিত হলেও এখন ভ্যারিয়েন্টের কারণে ১ জন থেকে ১৬ জন আক্রান্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনার টার্গেট এবার তরুণ প্রজন্ম। এতদিন দেখা যাচ্ছিল বিশ্বে বয়স্ক ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি করোনায় সংক্রমিত হচ্ছেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে যারা মারা যাচ্ছেন; তাদের মধ্যে বেশিরভাগই কম বয়সি। এ ভাইরোসের সংক্রমণ থেকে ৩০, ৪০ কিংবা ৫০ এর কোটায় মানুষেরা আর নিরাপদ নয়।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হঠাৎ করোনা আক্রান্তের নেপথ্য কারণ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার জন্য ভাইরাসের মিউটেশন বেশি হচ্ছে। ভাইরাসের ধরন প্রতিনিয়ত বদল হচ্ছে। তা ছাড়া তরুণদের মধ্যে সচেতনতার অভাবের বিষয়টিও রয়েছে। তরুণরা দেখছে, মূলত বয়স্করাই বেশি মারা যাচ্ছেন। সে কারণেই তারা স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করছে তারা। অনেক তরুণ এখনও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আড্ডা দিচ্ছে। অনেকের মুখেই মাস্ক নেই। কেউ আবার মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। মাস্ক দিয়ে শুধু থুঁতনি ঢেকে রেখেছে। নাক-মুখ খোলা। উদাসীনতার নামে এই স্মার্টনেস ডেকে আনছে ভয়াবহ বিপদ। নিজের জীবন দিয়ে এর মূল্য দিতে হচ্ছে।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, এক দিনে সুস্থ হয়ে উঠেছে ১৪ হাজার ৩৩৬ জন। তাদের নিয়ে এই পর্যন্ত সুস্থ হয়েছে ১০ লাখ ৫০ হাজার ২২০ জন। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি খুলনা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চট্টগ্রামে ৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া খুলনায় ৪৫, রাজশাহীতে ১৩, বরিশালে ১৪, রংপুরে ১১, ময়মনসিংহে ৯ এবং সিলেটে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন শনাক্ত রোগীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ রোগী ঢাকা বিভাগের ৬ হাজার ৯৯৬ জন। ময়মনসিংহে ৬৮৯ জন, চট্টগ্রামে ৩ হাজার ৭৬৮ জন, রাজশাহীতে ৭৩৫ জন, রংপুরে ৭৪৮ জন, খুলনায় ১ হাজার ১৯ জন, বরিশালে ৬৫৬ জন, সিলেটে ৬৬০ জনের শনাক্ত হয়েছে ২৪ ঘণ্টায়।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, শুরুতে করোনার প্রকোপ শহর এলাকায় বেশি ছিল। এখন গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। করোনায় ক্যানসার, কিডনি, হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা ও ডায়াবেটিক রোগ ছিল তাদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি ছিল। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে দেখা যাচ্ছে যেকোনো বয়সের যে কেউ সংক্রমণ ও মৃত্যু হচ্ছে।