হু হু করে বাড়ছে মৃত্যু: একদিনে ২৫৮ !

নাগরিক প্রতিবেদক

আবারও মৃত্যু বাড়ল। মঙ্গলবার করোনায় রেকর্ডসংখ্যক ২৫৮ জন মারা গেছে, যা এক দিনে মৃত্যুর সর্বোচ্চ সংখ্যা। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে মৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছেছে দুঃখ জাগানো নতুন উচ্চতায়। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে সোমবার ২৪৭ জন মারা গিয়েছিল।

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, করোনায় রোববার ২২৮, শনিবার ১৯৫, শুক্রবার ১৬৬, বৃহস্পতিবার ১৮৭, বুধবার ১৭৩ জন মারা গেছে। এই সাত দিনে করোনা ১ হাজার ৪৫৪ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ২০৭ জন মানুষ মারা গেছে। আর এ নিয়ে দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৯ হাজার ৭৭৯ জনের। বাড়তে থাকা মৃত্যুর সারি দেখে হতবিহ্বল সবার প্রশ্ন, এর শেষ কোথায়। প্রাণঘাতী এই করোনায় আর কত মৃত্যু দেখতে হবে?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আরও ২ থেকে ৩ সপ্তাহ করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। তীব্র ছোঁয়াছে ভারতীয় (ডেল্টা) ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপে একজন থেকে আরেকজনে দ্রুত ছড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এখন ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। যত বেশি ছড়াবে তাতে মিউটেশন হবে। নতুন ভ্যারিয়েন্ট যা আরও ভয়ঙ্কর হবে। এমনও হতে পারে ভ্যাকসিন কাজ করবে না।

২৪ ঘণ্টায় দেশে রেকর্ড ৫২ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে ১৪ হাজার ৯২৫ জনের মধ্যে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছে। শনাক্তের হার ছিল ২৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আগের দিনের চেয়ে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সামান্য কমেছে। ঈদের বন্ধের কারণে মাঝখানে কয়েক দিন নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ায় করোনা শনাক্ত কম হচ্ছিল; কিন্তু নমুনা পরীক্ষা বাড়তেই চিত্র পাল্টে গেছে।

করোনা সামাল দিতে দেশে ১৪ দিনের কঠোরতম লকডাউন চলছে। কিন্তু ঈদ শেষে কঠোরতম লকডাউন ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় ফিরছে মানুষ। শিমুলিয়া-বাংলাবাজারের নৌরুটে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে এখনও পদ্মা পার হচ্ছে মানুষ। ঢাকায় নানা অজুহাতে মানুষকে রাস্তায় বের হতে দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরা এসব বিষয়ে চরম অনীহা বিপদ বাড়াচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, বর্তমানে শহরের হাসপাতালে আসা ৭৫ শতাংশ রোগী গ্রামের। ঈদে যাওয়া-আসার কারণে সংক্রমণ ৫ থেকে ৬ গুণ বেড়েছে। করোনা চিকিৎসায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শয্যাসঙ্কট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। আইসিইউর জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, রাজধানীর ১৬টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের তিনটিতে আইসিইউ ব্যবস্থা নেই। আর আটটিতে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। বাকি পাঁচটি হাসপাতালে মাত্র ২২টি শয্যা ফাঁকা রয়েছে।

করোনার ভয়াবহতার মধ্যেই কোরবানির ঈদ উপলক্ষে বিধিনিষেধ শিথিল করেছিল সরকার। বিধিনিষেধ শিথিলে কোরবানির পশুর হাট, শপিংমল, মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি মোটেও মানা হয়নি। অনেকেই ঢাকা থেকে বাস, ট্রাক, লঞ্চে গাদাগাদি করে ঈদ করতে গেছে গ্রামে। ঈদের আগে লকডাউনের বিরতি দেওয়ায় ঝুঁকির কথা বলে আসছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। করোনাকালের ১৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিনগুলো পার করছে বাংলাদেশ।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ছিল ২৮ দশমিক শূন্য ৪৪ শতাংশ। কয়েকদিন ধরে শনাক্ত ২৯ থেকে ৩০ শতাংশে ওঠানামা করছে। দেশে এখন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, টানা দুসপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। সেখানে দেশে সংক্রমণের হার অতি উচ্চমাত্রায় অবস্থান করছে।

২৪ ঘণ্টায় ২৫৮ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরপরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু চট্টগ্রাম বিভাগে ৬১ জনের। এ ছাড়া খুলনা বিভাগে ৫০, রাজশাহী বিভাগে ২১, রংপুর বিভাগে ১১, ময়মনসিংহ বিভাগে ১১, সিলেট বিভাগে ৭ এবং বরিশাল বিভাগে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে এখন পর্যন্ত ১৯ হাজার ৭৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার ৯ হাজার ২০৩ জন ঢাকা বিভাগের। অর্থাৎ করোনায় বাংলাদেশে ৪৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ মানুষ মারা গেছে ঢাকার।

নতুন শনাক্ত রোগীদের মধ্যে প্রায় ৪২ শতাংশ ঢাকা বিভাগের ৬ হাজার ১৮৮ জন। রাজশাহীতে ৮৮১, চট্টগ্রামে ৩ হাজার ৪৮৭, খুলনায় ১ হাজার ৪৩৫, রংপুরে ৮৩৭, ময়মনসিংহে ৫৬৭, বরিশালে ৮২২, সিলেটে ৭০৮ জনের শনাক্ত হয়েছে ২৪ ঘণ্টায়। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৭৫২ জনে।

এ প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআরের) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলমগীর হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, করোনা সংক্রমণ এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আরও ২ থেকে ৩ সপ্তাহ চলমান থাকবে। সংক্রমণ ও মৃত্যু এর চেয়ে আরও বাড়তে পারে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট একজন থেকে আরেকজনে দ্রুত ছড়াচ্ছে। সংক্রমণ না কমলে নতুন ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টি হবে।

নতুন ভ্যারিয়েন্ট যা আরও ভয়ঙ্কর হবে। এমনও হতে পারে ভ্যাকসিন কাজ করবে না। লকডাউন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লকডাউনে করোনা সংক্রমণের হার কিছুটা কমে এসেছিল। নানা কারণে লকডাউন শিথিল করতে হয়েছে। এতে করে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে। ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সহযোগিতা করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু কমাতে পারে বলে তিনি মনে করেন। ড. আলমগীর বলেন, পুলিশ দেখলে মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় অনীহা। এসব বিষয় করোনা পরিস্থিতি আরও উদ্বিগ্ন পর্যায়ে চলে যাবে। মনে রাখতে হবে বাইরে বের হলে নিজে সংক্রমিত হবে, তার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হবে। করোনা থেকে বাঁচতে মাস্ক পরতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

Sharing is caring!