
করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে এখন প্রতিদিন অন্তত দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। গত ৪
জুলাই থেকে তা ক্রমান্তয়ে বাড়ছে। গত ২৭ জুন এর দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল একশ’র উপরে। কিন্তু
এখন তা দেড়শ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিষয়টিকে ভয়াবহ বলছেন অনেকে।
আজ বুধবার তিন দিনের মাথায় রেকর্ড ভেঙে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে মৃত্যু হলো ২০১ জনের, যা
এক দিনে মৃত্যুর সর্বোচ্চ সংখ্যা। এর আগে ১৬৩ জন মারা যায়। মহামারির ১৬ মাসে এত কম
সময়ে এত বেশি মৃত্যু আর কখনও দেখতে হয়নি বাংলাদেশকে।
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ডেল্টা) দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের ৬৪ জেলা সংক্রমণের অতি
উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে করোনা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর পর্যায়ে রয়েছে ৫৭ জেলায়। তীব্র
ছোঁয়াচে এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ভয়াবহ রেকর্ড হচ্ছে দিনকেদিন। দ্বিতীয় ঢেউয়ে
সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দুদিন ধরে নতুন রোগী
শনাক্ত হচ্ছে ১১ হাজারের ওপরে। গতকাল বুধবার নতুন করে ১১ হাজার ১৬২ জন রোগী শনাক্ত
হয়েছে। করোনায় এ পর্যন্ত সর্বাধিক ১১ হাজার ৫২৫ জন রোগী শনাক্ত হয় গত মঙ্গলবার।
এদিকে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমাতে সারা দেশে ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন চলছে। ইতোমধ্যে
লকডাউনের ৭ দিন পার হলেও গতি কমেনি সংক্রমণের। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
লকডাউন কার্যকর করার পর সংক্রমণের গতি কমতে আরও ১৪ দিন লাগবে।

গত মাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৭৮ শতাংশের দেহে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায় বলে জানিয়েছে
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। স্বাস্থ্য
অধিদফতর বলছে, এখন যে সংক্রমণ হচ্ছে তা সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণ গ্রামের
লোকজনের মধ্যে বেশি হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হতে আসা ৫০ শতাংশের বেশি রোগী গ্রামের। দুই
সপ্তাহ আগেও যেখানে দেশের ৪০ জেলা করোনা সংক্রমণের অতি উচ্চ ঝুঁকিতে ছিল, এখন দেশের
৬৪ জেলাই সংক্রমণের অতি উচ্চ ঝুঁকিতে। এর মধ্যে ৫৭ জেলায় সংক্রমণের হার ভয়ঙ্কর,
সর্বোচ্চ ৫৮ শতাংশ থেকে সর্বনিম্ন ২১ শতাংশের মধ্যে। বাকি সাত জেলাও অতি উচ্চ
সংক্রমণের মধ্যে রয়েছে।
এসব জেলায় সংক্রমণ হার ২০ থেকে সর্বনিম্ন ১৩ শতাংশের মধ্যে। ভয়ঙ্কর ৫৭ জেলার মধ্যে
সর্বাধিক সংক্রমণ টাঙ্গাইল ও ঝালকাঠিতে, ৫৮ শতাংশ। এরপর ৫৭ শতাংশ সংক্রমণ মাগুরা,
বরিশাল ও লালমনিরহাটে। ৫৫ শতাংশ সংক্রমণ ফেনীতে, পটুয়াখালীতে ৫১, গোপালগঞ্জ ও
পঞ্চগড়ে ৫০, মুন্সীগঞ্জ ও পিরোজপুরে ৪৯ শতাংশ। এ ছাড়া ৪৬ শতাংশ সংক্রমণ ফরিদপুরে, ৪৫
শতাংশ রাজবাড়ী, বরগুনা ও মৌলভীবাজারে, ৪৪ শতাংশ রংপুর ও খুলনায়, ৪২ শতাংশ বান্দরবানে,
৪০ শতাংশ গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে। এ ছাড়া ৩৯ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে সংক্রমণ রয়েছে ২৭
জেলায়। ২৯ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে সংক্রমণ রয়েছে ১২ জেলায়। এগুলো হলো- কিশোরগঞ্জ,
বগুড়া, ঢাকা, নীলফামারী, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, লক্ষ্মীপুর, নওগাঁ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পাবনা,
রাজশাহী ও জামালপুর।

অতি উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৬টি জেলায় সংক্রমণের হার ১৮ থেকে ১৩ শতাংশের মধ্যে। এর মধ্যে ১৯
শতাংশ সংক্রমণ মানিকগঞ্জে। এ ছাড়া কক্সবাজারে শনাক্ত হার ১৮ শতাংশ, নেত্রকোনায় ১৫
শতাংশ, জয়পুরহাটে ১৪ শতাংশ এবং নরসিংদী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৩ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ জুলাই করোনা শনাক্ত হয় ৯ হাজার ৯৬৪ জনের,
সংক্রমণ হার ২৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এ ছাড়া মারা যান ১৬৪ জন। অন্যদিকে গত ৪ জুলাই করোনা
শনাক্ত হয় ৮ হাজার ৬৬১ জনের, সংক্রমণ হার ২৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং মৃত্যু হয়েছে ১৫৩
জনের। ৩ জুলাই শনাক্ত ৬ হাজার ২১৪। সংক্রমণ হার ২৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। মৃত্যু হয়েছে ১৩৪
জনের।
বিপজ্জনক ও অতি উচ্চ সংক্রমিত এসব জেলায় এখন শহর বা পৌরসভার তুলনায় গ্রামে সংক্রমণ
৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। মৃত্যু বেড়েছে শনাক্তের চেয়েও বেশি। বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনরা
জানিয়েছেন, আগে পুরো জেলার মোট রোগীর ৮০ শতাংশই ছিল পৌরসভা বা শহর এলাকার। এখন
পৌরসভা, ইউনিয়ন ও প্রতিটি উপজেলায় সমান হারে রোগী পাওয়া যাচ্ছে। মৃত্যুহারও সমান। এমন
পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও আইইডিসিআর। বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, করোনাকে অগ্রাহ্য করা, স্বাস্থ্যবিধি না মানা এবং টিকার প্রতি আগ্রহী না হওয়ায়
গ্রামে সংক্রমণ বেড়ে গেছে।
রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি খুলনা ও রাজশাহীতে সংক্রমণ ও মৃত্যু ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ঢাকার
চেয়েও খুলনা বিভাগে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি থাকছে গত কয়েক দিন ধরে। মৃতদের এক-তৃতীয়াংশই
খুলনা বিভাগের বাসিন্দা। ২৪ ঘণ্টায় খুলনা বিভাগে সর্বাধিক ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকায় ৫৮
জন, চট্টগ্রামে ২১, রাজশাহীতে ১৮, রংপুরে ১৪, সিলেটে ৯, ময়মনসিংহে ৮ ও বরিশালে ৭ জনের
মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে নতুন শনাক্ত রোগীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক রোগী ঢাকা বিভাগের, ৪ হাজার ৭৩২ জন। এ
ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৯৯৭, রংপুরে ৯৭১, খুলনায় ১ হাজার ৯০০, চট্টগ্রামে ১ হাজার ৫৮৬, সিলেটে
৩৬২, ময়মনসিংহে ৩৯২ এবং বরিশাল বিভাগে ৬২২ জন শনাক্ত হয়েছে। নতুনদের নিয়ে দেশে এ
পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৮ জন।
মোট মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজার ৫৯৩ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৮ লাখ ৫০ হাজার ৫০২ জন।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৫ হাজার ৯৮৭ জন। আর গতকাল এক দিনে শনাক্তের হার ছিল
৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ। দেশে এখন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার
৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। সেখানে গত সাত দিন ধরে
করোনা শনাক্ত হার ২৫ থেকে ৩১ শতাংশে ওঠানামা করে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম
সাংবাদিকদের বলেন, এখন যে সংক্রমণ হচ্ছে তা কমিউনিটিতে ছড়িয়ে গেছে। সংক্রমণ গ্রামের
লোকজনের মধ্যে বেশি হচ্ছে। আমাদের কাছে যে হিসাব আছে, তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি ৫০
শতাংশের বেশি রোগী গ্রাম থেকে আসছে। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুম চলায় করোনায় আক্রান্ত হলেও
মানুষ একে জ্বর, সর্দি-কাশি ভাবছেন। সে কারণে হাসপাতালে আসছে কম। সময়মতো চিকিৎসার
অভাবে মৃত্যু বেশি হচ্ছে।