ঢাকায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ অবস্থা: আতঙ্কে নগরবাসী

নকীব মাহমুদ, ঢাকা

রাজধানী ঢাকায় এবার হানা দিয়েছে ডেঙ্গু। করোনার প্রকোপ কাটতে না কাটতেই ডেঙ্গুর ছোবলে মরতে শুরু করেছে মানুষ। শনিবার ১০৪ জন আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। এর বাহিরেও সংখ্যা আরও বেশি। নগরবাসী এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু এ নিয়ে কোন বাধা ব্যাথা নেই দুই সিটির মেয়রের। তারা দিন রাত
পুরনো বুলি আওড়িয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু সমাধান দিতে পারছেন না।

এদিকে ডেঙ্গুর ভয়াবহ অবস্থা তৈরী হওয়ার পেছনে দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন, বর্তমান মেয়র তাপসকেই দায়ী করছেন নগরবাসী। তারা বলছেন, প্রতি বছর মশা মারার ওষুধ কিনতে যে বাজেট করা হয় তার পুরোটাই মেরে খায় মেয়র ও তার লোকজন। এছাড়াও সিটির কর্মকর্তারা জড়িত। আর যারা ওষুধ সরবরাহ করেন তারাও ভেজাল ওষুধ দেন। এই তিন পক্ষের একটি যোগসাজস রয়েছে। ফলে মশা নিধন হয় না।

শনিবার ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ১০৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, যা চলতি বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তির রেকর্ড। আগের দিন গত শুক্রবার ৮৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। চলতি মাসের জুলাইয়ের ২৪ দিনে ১ হাজার ২০২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।

এই সংখ্যা বছরের প্রথম ছয় মাসের প্রায় চারগুণ। আগের ছয় মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৯২। শুধু তাই নয়, গত বছরের পুরো ১২ মাসের সঙ্গে এই বছরের জুলাই মাসের ২৪ দিন তুলনা করলে আক্রান্ত প্রায় সমান। গত বছর ১২ মাসে ১ হাজার ৩৯২ জন আক্রান্ত হয়েছিল। বর্তমান এই পরিস্থিতিকে ভয়াবহ মনে করছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ৫৭৪ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪৪ জন ঢাকার বাইরের জেলার বাসিন্দা। সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৪২২ জন রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই আছে ৪১৯ জন, আর বাকি ৩ জন ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগে। ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া ১০৪ জন রোগীর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ৩১ জন ও বেসরকারি হাসপাতালে ৭৩ জন। সরকারি হাসপাতালের মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ২১ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে পাঁচজন ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৯ জন। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে মোট ভর্তি ৭৩ জনের মধ্যে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৭ জন, ইবনে সিনা হাসপাতালে ১ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ৮ জন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৯ জন, গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ৩ জন, ইসলামি ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৩ জন, খিদমাহ হাসপাতালে ৬ জন, সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ জন, এভারকেয়ার হাসপাতালে ৬ জন, আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৭ জন, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১ জন, বিআরবি হাসপাতালে ১ জন, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ২ জন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২ জন, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ২ জন, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩ জন ও উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ১ জন ভর্তি হন। এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩ জনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকার দুই সিটিতেই সড়কের ওপর এখনও কোরবানির পশুর বর্জ্য পড়ে রয়েছে। রাস্তার দুই পাশে কোরবানির পশু জবাই করা হয়েছে। সেখানে রক্ত ও মলমূত্র পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ধীরগতিতে চলছে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিষ্কারের কাজ। এগুলো মশার প্রজননক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এর আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছিল। ওই বছর ডেঙ্গুতে সরকারি হিসাবে ১৭৯ জন মারা গিয়েছিলেন। ওই বছর সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। গত বছর ডেঙ্গুর এত প্রকোপ দেখা যায়নি। দুই সিটি করপোরেশন চিরুনি অভিযানসহ বেশ কিছু কার্যক্রম চালায়।

ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতিকে ভয়াবহ মনে করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে বলেছি। কিন্তু এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ঢাকার সব এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব অনেক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকার সব এলাকা ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকির মধ্যে আছে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব যখন দেখা দেয় তার আগে কোরবানির ঈদ ছিল। ঈদে অনেক মানুষ গ্রামে যায়। এরপরই সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। এবারও ঈদে লোকজন দল বেঁধে বাড়ি গিয়েছেন। এতে ডেঙ্গু গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, এডিস মশার উৎস ধ্বংসে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি বাড়ির মালিকেরও দায়িত্ব রয়েছে। বাড়ির ভেতরে পানি জমতে পারে এমন সব ধরনের পাত্র নষ্ট করে ফেলতে হবে। সিটি করপোরেশনের সব খোলা জায়গা, রাস্তা ও পার্কে জমা থাকা পানির উৎস নষ্ট করতে হবে। আর উড়ন্ত এডিস মশা ফ্রগিং মেশিনে স্প্রে করে মেরে ফেলতে হবে।

তিনি বলেন, এডিস নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিটা ভিন্ন। ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বাড়লেই আমরা নড়েচড়ে বসি। কিন্তু বছরব্যাপী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে। কলকতায় বছরব্যাপী কাজ করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. আবদুল আলীম বলেন, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর হচ্ছে মশার প্রজননকাল। এ সময় মশার বংশ বিস্তার করে। আর এডিস মশার বংশ বিস্তার করে পরিষ্কার পানিতে। এ ছাড়া ডাব খেয়ে মানুষ যেখানে-সেখানে খোলস ফেলে, ডাবের খোলসে, বাসাবাড়ির ড্রাম, ফুলের টবে, পার্কে গাছের গোড়ায়, নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানিতে এডিস জন্মে। নর্দমা বা ময়লা পানিতে এডিস বংশ বিস্তার করে না।

তিনি বলেন, যেখানে-সেখানে জমে থাকা পানি সরাতে হবে। এককথায় মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মানুষকে সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে কিংবা জ্বর হলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় বিষয় উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু করণীয় রয়েছে। বাসাবাড়িতে রাখা ফুলের টব বা অন্যান্য স্থানে জমে থাকা পানি তিন দিনের মধ্যে ফেলে দিতে হবে। যারা বাসা ছেড়ে তিন দিনের বেশি সময়ের জন্য বাইরে যাচ্ছেন, কমোডের প্যান ঢেকে রাখতে হবে, পানির যেকোনো পাত্র পানিশূন্য করে উল্টিয়ে রাখতে হবে। দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা উত্তম।

Sharing is caring!