আকাশ পথে টিকেটের দাম চড়া: নিরব সরকার

নকীব মাহমুদ, ঢাকা:

শরীয়তপুরের লিটন সরকার। দীর্ঘদিন কাতারে ছিলেন। গতবার করোনার কারণে দেশে এসে আটকে যান। গত ১৭ এপ্রিল তিনি আবারও কাতার ফিরে গেছেন। তবে সেখানে যাওয়ার আগে তাকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়েছে। কারণ একটাই ঋণের টাকা ছাড়া ফ্লাইটের টিকেটের খরচ মেলানো সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই ঋণ করেন আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে। এখন কাতারে কাজ করে সেই টাকা শোধ করবেন। এখানেই শেষ নয়, কাতারে তিনি প্রবেশ করলেও এখনও সেখানে একটি হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে আছেন তিনি। ২৯ তারিখ পর্যন্ত থাকবেন। এই পুরো সময়ে থাকা ও খাওয়া বাবদ সব খরচ তার। লিটন বলেন, টিকেট আর হোটেল ভাড়া দিতেই সব শেষ। খাব কী আর আয় করে গ্রামে টাকা কতটুকু পাঠাব সেই চিন্তাই করছি।

গাজীপুরের আতাহার আলী। সৌদিতে ছিলেন। তিনিও গত বছর দেশে আসেন। এবার আবারও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চলতি মাসে যাওয়ার পরিকল্পনা তার। কিন্তু টিকেট কিনতে গিয়ে চোখ ছানাবড়া। আগের মূল্যের কয়েকগুণ বেশি দামে বাধ্য হয়ে টিকেট কিনছেন অনেক প্রবাসী। চলতি সপ্তাহে তিনি যাবেন মন স্থিরও করেছিলেন। কিন্তু সেই টাকা এখনও হাতে নেই তার। ফলে ভাবছেন নিজের তিন শতক ধানি জমি বিক্রি করে টিকেট কিনবেন। শুধু শরীয়তপুরের লিটন আর গাজীপুরের আতাহারই নন, তাদের মতো এখন অনেকের চড়া দামে টিকেট কিনতে নাভিশ^াস অবস্থা।

প্রবাসীরা জানিয়েছেন, তারা আগে যে ভাড়ায় যাতায়াত করতেন তার থেকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া লাগছে। কর্মে ফিরতে জনপ্রতি ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা লাগছে। এই ভাড়া কেন বৃদ্ধি হয়েছে তার কোনো জবাবও তারা পাচ্ছেন না এয়ারলাইন্সগুলোর কাছ থেকে। এই বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কারও যেন কোনো মাথা ব্যথা নেই। বায়রা থেকে বিষয়টির আপত্তি জানিয়ে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে জানানো হলেও সেটির কোনো সমাধান মেলেনি এখনও। করোনার আগে আগে যেখানে কাতার যেতে ২০০ থেকে ২৫০ ডলার লাগত। এখন সেখানে প্রতিজনকে হাজার ডলার গুনতে হচ্ছে।

প্রবাসীরা আরও বলছেন, বিশেষ ফ্লাইট চালুর পর থেকে বাংলাদেশ বিমান ছাড়া প্রতিটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স তাদের টিকেটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে কাতার যেতে যেখানে ২০ হাজার টাকা লাগত এখন সেখানে ৯০ হাজারের বেশি টাকা লাগছে। এ ছাড়াও সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত যেতে আরও বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে তাদের। এসব প্রবাসী বেশি দামে টিকেট কেনার পর ওই দেশে ঢোকার আগে কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন। ফলে সেখানেও তাদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত খরচ। এসব মিলে অধিকাংশ প্রবাসীর কাছে এখন কর্মে ফেরার অর্থ জোগাড় করাটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অ্যাভিয়েশন, ট্রাভেল এজেন্সি ও বায়রা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি দেশের এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্টরা কতদূর যেতে কত ভাড়া হবে তা নির্ধারণ করে থাকেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কোনো তালিকা করা হয়নি। ভাড়া বৃদ্ধির পর থেকে বায়রা নেতারা বেবিচক সংশ্লিষ্টদের একটি ভাড়ার তালিকা তৈরির করার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এমনকি কতদূর যেতে কত টাকা ভাড়া গুনতে হবে তারও কোনো তালিকা নেই। সেই তালিকা থাকলে অন্তত এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করা যেত।

বায়রার সদ্য মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, টিকেটের দাম বৃদ্ধি করার কোনো ব্যাখ্যা এখনও আমাদের দেয়নি এয়ারলাইন্সগুলো। তাদের দাবি, বাংলাদেশ থেকে ফুয়েল খরচ বেশি হওয়ায় টিকেটের ভাড়াও বেশি রাখছে। এই ভাড়াটা করোনা পরিস্থিতি আসার পর থেকে বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে এখন কয়েকগুণ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা বেবিচককে বলেছি, তারা যেন এয়ারলাইন্সগুলোকে বলে এবং তাদের সুবিধা বাড়িয়ে দেয়। তারা বলেছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ ফ্লাইট চালুর ফলেই টিকেটের দামটা বেশি বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ ফ্লাইটের সুযোগ নিয়ে এয়ারলাইন্সগুলো এই কাজ করছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় দাম কয়েকগুণ বেশি। এই মুহূর্তে যা একজন প্রবাসীর জন্য কষ্টকর। অনেকের প্রবাসে যাওয়ার মতো টাকাও নেই। ধারকর্জ করে সেই টাকা সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। তারা আরও বলছেন, যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের দেশ থেকে প্রবাসে যেতে বেশি টাকা গুনতে হয়। পাশের দেশ ভারত ও নেপাল ছাড়াও আশপাশের দেশ থেকে যেতে যেখানে ২০-৩০ হাজার টাকা লাগছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে লাগছে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশে এমন হওয়ার জন্য অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন তারা। তারা বলছেন, বিমান চাইলে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তারা প্রবাসীদের জন্য এভারেজ ভাড়া আদায় করলে তারাও উপকৃত হয়।

বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিজুর রহমান বলেন, এয়ারলাইন্সগুলোর প্রতি নির্দেশনা আছে তারা যেন টিকেটের দাম বৃদ্ধি না করে। আমরা তাদের অনেক সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিয়েছি। বলা হয়েছে, যাতে কোনোভাবে এই সময়ে টিকেটের দাম না বাড়ানো হয়। এগুলো বিষয় নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সব এয়ারলাইন্সের সঙ্গে কথাও বলেছি। তবে দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব রিক্রুটিং এজেন্সি, বায়রা ও মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। তারা নজরদারি করবে, টিকেটের দাম কেন বাড়ানো হচ্ছে।

বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলার মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ও জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, একটি ফ্লাইট যখন যাচ্ছে তাতে যাত্রী থাকছে কিন্তু ফেরত আসার সময় কোনো যাত্রী নেওয়া হচ্ছে না। ফ্লাইটগুলো যাওয়া-আসার জন্য ডাবল সিট ফাঁকা রাখতে হচ্ছে। এ ছাড়াও অন্যান্য খরচ মিলে ক্ষতি পোষাতে অনেকেই টিকেটের দাম বেশি রাখছেন। এদিকে বিমানের বাংলাদেশের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআর) তাহেরা খন্দকার দাবি করেছেন, তারা টিকেটের নির্ধারিত মূল্যই রাখছেন। বেশি নিচ্ছেন না।

ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, টিকেটের দাম কিন্তু লাগামহীন হারেই বাড়ছে। তার সঙ্গে যখন অব্যবস্থাপনা যুক্ত হয় এবং ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন আরও বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই অভিবাসন খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। তার সঙ্গে যদি এই টিকেটের দাম বেশি রাখা হয়, তা হলে লোকগুলো কোথায় যাবেন? তাদের যদি টিকেটের দাম তুলতেই পুরো বছর যায়, তা হলে তারা কী আয় করবে আর কী দেশে পাঠাবে। এ জন্য বিমানটির একটি উদ্যোগ নিতে হবে। তা হলে বিষয়টি সমাধান সম্ভব।

Sharing is caring!