
সাবিত মোস্তফা
ঢাকা নগরীতে নির্দিষ্ট কিছু জায়গা ও সড়ক ছাড়া কোথাও টোল আদায় করা হয় না। কিন্তু একটি প্রতারক চক্র জাল রশিদ বানিয়ে টোল আদায়ের নামে কোাটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে রাজধানীর রামপুরা-খিলগাঁও সড়কে যানবাহনের কাছ থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) টোল আদায়ের নামে চলছে বেশুমার চাঁদা আদায়। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষের জাল রসিদ। সিএনজি অটোরিকশা-লেগুনা থেকে শুরু করে এ রুট দিয়ে চলা সবরকম যানবাহন থেকে আদায় করা হচ্ছে এ ‘টোল’।
এর মাধ্যমে একটি চক্র লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে পরিবহন খাত থেকে। তাদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছে যে, টাকা না দিলে রাস্তার মাঝেই গাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি চাঁদা না দেওয়ায় গাড়ি ভাঙচুর, চালক ও তার সহকারীকে মারধর করার মতো ঘটনাও অহরহই ঘটছে। অন্য কোনো রুটের গাড়ি কোনো প্রয়োজনে এ রুট দিয়ে যাতায়াত করলে সেগুলোর কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
গতকাল রামপুরা-খিলগাঁওয়ের বিভিন্ন সড়কে ঘুরে, পরিবহন মালিক-চালকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে। হাতে এসেছে চাঁদাবাজদের সরবরাহকৃত ডিএসসিসির জাল টোল রসিদের একাধিক কপিও। মালিক-চালকদের অভিযোগ, একশ্রেণির অসাধু পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে পরিবহন চাঁদাবাজরা।
এ চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের অন্যতম হলেন মো. সেলিম। চাঁদা আদায় থেকে শুরু করে প্রতিবাদকারীকে শায়েস্তা করতে তার রয়েছে বিশাল বাহিনী। সর্বশেষ, সেলিম ও তার বাহিনীর দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন ডিএসসিসির রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক রানা। গত বৃহস্পতিবার খিলগাঁও থানায় তিনি অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ ছাড়া গত ৩১ মার্চ পরিবহন চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে একই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর ২০২০) করেছেন মো. রাসেল সরদার নামে স্বাধীন পরিবহনের এক চালক।
এদিকে থানায় অভিযোগের পর দমে না গিয়ে চাঁদাবাজরা উল্টো ‘দাবিকৃত চাঁদা না দিলে চাকা ঘুরবে না; রাস্তায় গাড়ি নামালে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে’ বলে লাগাতার হুমকি দিচ্ছে সেলিম ও তার বাহিনীÑ এমন অভিযোগ করেছেন পরিবহন মালিক-চালকরা।
ডিএসসিসির কর্মকর্তা রাজ্জাক রানা আমাদের সময়কে জানান, রামপুরা-খিলগাঁওয়ের আওতাধীন মেরাদিয়া বাজার এলাকা থেকে ছাড়া বিভিন্ন পরিবহনের বাস হতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের টোল আদায়ের জন্য অভিযুক্ত মো. সেলিমকে তিনিই দায়িত্ব দিয়েছিলেন বছরখানেক আগে। তা হলে আরও আগে কেন সেলিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, আমাদের সময়ের এমন প্রশ্নে তিনি জানান, দিন দশেক আগে ভুক্তভোগী চালক ও তাদের সহকারীদের মারফত তিনি জানতে পেরেছেন সেলিমের দুষ্কর্ম সম্পর্কে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের টোল আদায়ের রসিদ জাল করে ছাপিয়ে সেটি চালকদের হাতে ধরিয়ে দিত সেলিম প্রাপ্ত চাঁদার বিপরীতে। তার এমন জাল-জালিয়াতির কারণে ডিএসসিসি বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল।
ডিএসসিসির রাজস্ব আদায়কারী এই কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে সেলিমকে সতর্ক করা হলেও তিনি অপকর্ম বন্ধ না করায় টোল আদায়ের কাজ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু এর পরও খিলগাঁওয়ের চিহ্নিত চাঁদাবাজ শাহীন, সজীব, সুমনসহ আরও ১৪-১৫ জন সন্ত্রাসী সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রকাশ্যেই প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত জাল রসিদ দিয়ে কিংবা রসিদ ছাড়াই সিটি করপোরেশনের নামে অবৈধভাবে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি টোলের মোড়কে তার এ চাঁদাবাজিতে ত্যক্তবিরক্ত চালকদের অনেকে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের কারও কারও ওপর শারীরিক নির্যাতনও চালায় সেলিমের সঙ্গী সন্ত্রাসীরা। একপর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে মনে হওয়ায় আমি থানায় অভিযোগ দায়েরে বাধ্য হয়েছি।
এদিকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খিলগাঁও থানাপুলিশ দুই চাঁদাবাজকে গত শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে আটক করে। কিন্তু বিকাল ৩টার দিকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় ‘রহস্যজনক’ কারণে, বলেন রাজ্জাক রানা।
রামপুরার মেরাদিয়া হয়ে গাবতলী পর্যন্ত রুটে চলে রবরব পরিবহন। এ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সুমন আলী বলেন, সড়কের চাঁদাবাজদের কাছে আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি। তারা প্রতারকও বটে। জাল রসিদ দিয়েও রামপুরা বনশ্রী এলাকার সড়ক দিয়ে চলা যানবাহনের কাছ থেকে টোলের নামে অবৈধভাবে টাকা তোলা হয়।
সুমন আলী উদ্বেগের সঙ্গে যোগ করেন, পুরো বিষয়টি থানাপুলিশকে জানানোয় হিতে বিপরীত হয়েছে। চাঁদাবাজরা এখন আমাদের হুমকি দিয়েছে, চাঁদা না দিলে রাস্তায় গাড়ি তো চলতে দেওয়া হবেই না, বরং যারা অভিযোগ করেছে তাদের ‘দেখে নেওয়া হবে’। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন রুটে যানবাহন চালাতে হলে চাঁদা দিয়েই চালাতে হবে বলে সদর্পে বলে বেড়াচ্ছে সেলিম গং। এমন পরিস্থিতিতে রাস্তায় গাড়ি নামাতেও ভয় পাচ্ছেন চালক ও মালিকরা। তারা ভুগছেন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। অভিন্ন মন্তব্য করেন রামপুরার মেরাদিয়া হয়ে শিয়া মসজিদ-মোহাম্মদপুর রুটের আলিফ পরিবহনের এমডিসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের মালিক-চালকও।
এদিকে যার বিরুদ্ধে এতসব অভিযোগের পাহাড়, সেই সেলিম বরং অভিযোগের আঙুল তুলে ধরেছেন ডিএসসিসির কর্মকর্তা রাজ্জাক রানার দিকে। তিনি বলেন, ডিএসসিসির কর্মকর্তা রাজ্জাক রানা টোলের যে পরিমাণ রসিদ আমাকে দিত, সেগুলোই আমি চালকদের দিয়েছি টোলের বিপরীতে। জাল-জালিয়াতির সঙ্গে তার কোনোরকম সম্পৃক্ততা নেই, দৃঢ়তার সঙ্গে এমন দাবি করেন তিনি। রাজ্জাক রানাকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, যারা আমার বিরুদ্ধে পরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলছেন, মূলত তারাই এ চাঁদাবাজির নেপথ্য হোতা।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় খিলগাঁও থানার ওসি মশিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ ধরনের অভিযোগ পেয়েছি। থানায় অভিযোগের পর পরিবহন মালিক-চালকদের হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা খতিয়ে দেখা হবে।