সম্পদের হিসেব না দিলেই বিভাগীয় মামলা

নাগরিক প্রতিবেদক

‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীরা স্থাবর সম্পত্তি অর্জন, বিক্রয় ও সম্পদ বিবরণী নির্ধারিত সময়ে জমা না দিলে তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা করা হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারও সম্পদ বিবরণী সন্দেহজনক মনে হলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হবে। সরকারের এ উদ্যোগ সফল হলে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ অনুযায়ী পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও ‘বিবরণী দাখিলের নির্ধারিত ছক’ না থাকায় ৩১ বছরেও এটি কার্যকর করা যায়নি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনে বিধিমালাটি কার্যকরের মাধ্যমে সম্পদের হিসাব দেওয়াসহ নিয়ম মানতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের কাছে চিঠি পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

চিঠিতে ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’-এর আওতাভুক্তদের তাদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়-দফতরের অধীনস্থ সংস্থায় কর্মরত সব সরকারি কর্মকর্তার সম্পদ বিবরণী জমা, ওই সম্পদ বিবরণীর ডাটাবেজ তৈরি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে স্থাবর সম্পত্তি অর্জন ও বিক্রয়ের অনুমতি নেওয়ার বিষয়ে ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’-এর ১১, ১২ এবং ১৩ বিধি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতিপালনের মাধ্যমে জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। সরকারি কর্মচারীর জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাটসহ সম্পত্তি ক্রয় বা অর্জন ও বিক্রির অনুমতির জন্য আবেদনপত্রের নমুনা ফরম এবং বিদ্যমান সম্পদ বিবরণী দাখিলের ছক চিঠির সঙ্গে পাঠানো হয়।

‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’-এর ‘মূল্যবান স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়’ উপ-শিরোনামের ১১ বিধিতে বলা হয়েছে, ‘প্রকৃত ব্যবসায়ীর সহিত সরল বিশ্বাসে লেনদেনের ক্ষেত্র ব্যতিরেকে একজন সরকারী কর্মচারী তাহার কর্মস্থল, জেলা বা যে স্থানীয় এলাকার জন্য তিনি নিয়োজিত, ওই এলাকায় বসবাসকারী, স্থাবর সম্পত্তির অধিকারী অথবা ব্যবসা বাণিজ্যরত কোনো ব্যক্তির নিকট পনেরো হাজার টাকার অধিক মূল্যের কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়, বিক্রয় বা অন্য কোনো পন্থায় হস্তান্তর করিতে চাহিলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রধান বা সরকারের সচিবের নিকট নিজের এ অভিপ্রায় ব্যক্ত করিবেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মচারী নিজেই বিভাগীয় প্রধান হইলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমে এবং সরকারের সচিব হইলে সংস্থাপন (জনপ্রশাসন) মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমে সরকারের নিকট অভিপ্রায় জানাইবেন। উক্ত অভিপ্রায়ের বক্তব্যে লেনদেনের কারণ ও স্থিরকৃত মূল্যসহ লেনদেনের সম্পূর্ণ বিবরণ এবং ক্রয়-বিক্রয় ব্যতীত অন্য কোনো পদ্ধতিতে হস্তান্তর করা হইলে, উক্ত হস্তান্তরের পদ্ধতি উল্লেখসহ লেনদেনের সম্পূর্ণ বিবরণ থাকিবে। অতঃপর সরকার কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ অনুসারে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী কাজ করিবেন। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী তাহার অধঃস্তন কর্মচারীর সহিত সকল প্রকার লেনদেনের ক্ষেত্রে পরবর্তী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করিবেন।’

‘ইমারত নির্মাণ, ইত্যাদি’ উপ-শিরোনামের ১২(১) বিধিতে বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী নির্মাণ ব্যয়ের প্রয়োজনীয় অর্থের উৎসের উল্লেখপূর্বক আবেদনের মাধ্যমে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ না করিয়া ব্যবসায়িক বা আবাসিক উদ্দেশ্যে কোনো ইমারত নির্মাণ করিতে পারিবেন না।’
৩১ বছরেও এই বিধি কার্যকর না হলেও ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নির্দেশে ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয় ও এর অধীন সব দফতরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নির্দেশ জারি করেছিল ভূমি মন্ত্রণালয়। তবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হওয়ায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নিতে পারেনি ভূমি মন্ত্রণালয়। ভূমি মন্ত্রণালয় ও এর অধীন সংস্থার ১৭ হাজার ৫৭৬ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর মধ্যে ১৭ হাজার ২০৮ জন সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল করে। বিভাগীয় মামলায় সাময়িক বরখাস্ত এবং দীর্ঘমেয়াদি ছুটিতে থাকার কারণে ৩৬৮ জন কর্মচারী সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে পারেননি।

সদ্য অবসরে যাওয়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ইউসুফ হারুন বলেন, ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ অনুযায়ী কোনো সরকারি চাকরিজীবী সম্পদ বিবরণী দাখিল না করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। বিধিমালা হওয়ার ৩১ বছরেও এটা কেন কার্যকর করা হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিধিমালায় বলা আছে একটা নির্ধারিত ছকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে হবে। কিন্তু এতদিন এই অনুমোদিত কোনো ছক ছিল না বলেই এটা কার্যকর করা যায়নি। সম্প্রতি এই নির্ধারিত ছক অনুমোদন করার পর সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সম্পদ বিবরণী দাখিলের পর কারও সম্পদ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছেও পাঠাতে পারবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজম বলেন, আমরা সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি নিয়মিত কাজের অংশ করে নিতে চাই। কেউ চাকরি জীবনে এলে, অন্যান্য কাজের মতো সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি তার রুটিন দায়িত্বের মধ্যে থাকবে। এটা হলে কর্মকর্তারা তার সম্পদের বিষয়ে আপডেটেড থাকবেন। আমরা প্রথমে তাগিদ দিয়ে চিঠি দিলাম। কিছুদিনের মধ্যে সময় বেঁধে দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, সরকারি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নেওয়ার এখতিয়ার দুদকের নেই। তবে দুদকের যদি সন্দেহ হয় কোনো কর্মকর্তার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি কিংবা বেতনের তুলনায় তার জীবনযাপন অসামঞ্জস্যপূর্ণ তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে তার আয়কর দেওয়ার হিসাব চাওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ব্যাংকের হিসাবও চাওয়া হয়। এ ছাড়া কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি কোনো ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায় তা হলে সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব চাওয়ার একমাত্র এখতিয়ার হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের।

সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের শুধু সম্পদের হিসাব দিলেই হবে না। তাদের আয়ের সঙ্গে সম্পদের সামঞ্জস্য রয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাই করতে হবে। তিনি বলেন, ৫ বছর পরপর সম্পদের হিসাব দিলে দুর্নীতির প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি চাকরি আইনে বলা আছে পাঁচ বছর পরপর সবাই সম্পদের হিসাব দেবে। যাতে করে আয়বহির্ভূত কোনো সম্পদ আছে কি না, সেটা আমরা চেক করতে পারি। সরকারি চাকরিজীবীরা ট্যাক্স রিটার্ন দেবেন। আমাদেরকেও তাদের সম্পদের হিসাব সাবমিট করতে হবে। কেউ তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চাইলে আমরা দিতে পারব।

Sharing is caring!