
মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যয় কি হচ্ছে, করোনায় কত টাকা ব্যয় হবে এবং ব্যয় না হলে সেই টাকা কি হবে তা নিয়ে কোন জবাবদিহি নেই। এমনকি বিষয়গুলো জানাচ্ছেনও দায়িত্ব থাকা ব্যক্তিরা। করোনার কারণে এ প্রকল্পে কাজ করা জাপানীরা আসতে পারবে না এবং কেনাকাটায় নানা অসুবিধাও আছে। এসব বিষয় কর্তৃপক্ষকে না জানানোয় প্রকল্প কর্মকর্তাদের এমন কাণ্ডকে দায়িত্বহীনতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় গঠিত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনের অংশ হিসেবে নির্মাণ করা হচ্ছে মেট্রোরেল। এর একটি এমআরটি-৬ নামে পরিচিত; উত্তরা থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত সেটির রুট। এ মেট্রোরেলের বাস্তবায়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে চলমান করোনা মহামারীর কারণে। ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম মেট্রোরেল এমআরটি লাইন-৬ নামে পরিচিত। এ প্রকল্পের ওপর অনুষ্ঠিত প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভায় প্রকল্প কর্মকর্তাদের গাফিলতির বিষয়টি প্রথম উঠে আসে। এর পর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের নির্দেশে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা সরকার গাফিলতির বিষয়টি চিহ্নিত করে দায় নিরূপণে প্রতিবেদন জমা দেন।
সেখানে বলা হয়, এমআরটি লাইন-৬ এর বিপরীতে বৈদেশিক ঋণ সহায়তা খাতে বরাদ্দকৃত টাকা আরএডিপিতে অন্তর্ভুক্তকরণে গাফিলতি করেন প্রকল্প পরিচালক ও প্রকল্প ব্যবস্থাপকরা। সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- সামগ্রিক পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, প্রকল্পের ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) বৈদেশিক সহায়তা খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব কমানোসহ ব্যয় খাত সংশোধনে অযথা কালক্ষেপণ করা হয়েছে।
মূলত বিষয়টি হচ্ছে, চলতি অর্থবছরে এমআরটি লাইন-৬ এর প্রকল্প সাহায্য খাতে তিন হাজার ৭৮০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা ছিল। এর পর গত বছরের ২৫ নভেম্বর এডিপি সংশোধনকালেও একই বরাদ্দ রাখা হয়। তখন প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানায়নি করোনার কারণে ওই টাকা নিয়ে তাদের আপত্তি আছে। সবার মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠানো হয়। বৈদেশিক সাহায্য খাতের বরাদ্দ চূড়ান্ত হওয়ার পরই দেশীয় অর্থ বরাদ্দ হয়। এর পর পার হয় দুই মাস। ৬৩ দিন পর এক হাজার ৪২৩ কোটি টাকা কমানোর প্রস্তাব পাঠায় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। ততদিনে সংশোধনের সুযোগ শেষ। এর পরও প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশন ও ইআরডিতে পাঠালে তা ফেরত পাঠানো হয়।
এ ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যায় প্রকল্প পরিচালক জানান, বাংলাদেশিদের জাপান সফরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময়সীমা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং এখনো বিদেশি জ্যেষ্ঠ কর্মীরা জাপান থেকে ঢাকায় না আসায় মেট্রোরেলের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাতে ক্রয় ও সংগ্রহ কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে বলে মন্ত্রণালয় অনুষ্ঠিত সভায় তুলে ধরা হয়। এ কারণে বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় করার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মন্তব্য করেন তারা। তা হলে অর্থ কেন ফেরত দেওয়া হয়নি তার জবাবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সদুত্তর দিতে পারেনি।
এ বিষয়ে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক লিখিতভাবে জানিয়েছেন, ‘পারস্পরিক অনানুষ্ঠানিক আলোচনা থেকে ধারণা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশিদের জাপান সফরের নিষেধাজ্ঞা চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারির পর আর বাড়বে না। এ প্রেক্ষাপটে ইআরডির নভেম্বরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি চূড়ান্ত করার সময় ব্যয় হ্রাসের বিষয়টি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব হয়নি।’
এদিকে মন্ত্রণালয় গঠিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, যথাসময়ে বরাদ্দ প্রস্তাব চূড়ান্ত করার দুই মাস পর টাকা কমানোর প্রস্তাব ‘প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনায় যথেষ্ট অদূরদর্শিতার পরিচয়’। এখন বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করতে না পারলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি বৈদেশিক সহায়তা খাতে ১৯.৫৩ শতাংশ কমবে। সার্বিক এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি কমবে ৫.৫২ শতাংশ। এতে এ বিভাগের ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে এমআরটি-৬ মেট্রোরেলটির গড় অগ্রগতি ৬১.৪৯ শতাংশ। প্রথম পর্যায়ের জন্য নির্ধারিত উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও অংশের কাজের অগ্রগতি ৮৩.৫২ শতাংশ। দ্বিতীয় পর্যায় আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণ অগ্রগতি ৫৭.৬৮ শতাংশ। ৮টি প্যাকেজে প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রথম মেট্রো ট্রেন সেট জাপানের কোবে সমুদ্রবন্দর থেকে মোংলা বন্দরে এসে ভেড়ে ৩১ মার্চ। ২৩ এপ্রিল সেগুলো পৌঁছাবে উত্তরার মেট্রোরেল ডিপোতে। দ্বিতীয় মেট্রোসেট এর শিপমেন্ট এ মাসের ১৫ তারিখ।