মোস্তফা ইমরুল কায়েস

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার চারপাড়া এলাকার সোহেল রানা ওমানে থাকতেন। সেখানে একটি বাসায় কাজ করতেন। বেতনও ভালো পেতেন। তার আয়েই চলত অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা ও সংসার। গত জানুয়ারিতে এক মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। আর যেতে পারেননি। অন্যদিকে তার আকামার (কাজের অনুমতিপত্র) মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে ফ্লাইট চালু হলেও আর চাকরিতে যোগদান করতে পারবেন কি না তা নিয়েই সন্দেহে আছেন সোহেল। সোহেল জানালেন, তার চাকরি যাতে থাকে এ জন্য মালিককে বহুবার ফোনও করেছেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাননি। জমানো টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় ঢাকায় এসেছিলেন এবং কিছুদিন রাজমিস্ত্রিরও কাজ করেছেন। এরপর একটি কাপড়ের দোকানে মাত্র আট হাজার টাকায় চাকরি নেন। কিন্তু সেই দোকানও এখন বন্ধ। সব মিলে সোহেল এখন পুরো বেকার। সংসারও চলছে টানাপড়েনে।
সোহেল বলেন, খুব আশা নিয়ে দেশে এসেছিলাম বোনের বিয়ে দেব বলে; কিন্তু সেটাও পারছি না। লাখ টাকা ঋণ, এখন পুরোপুরি ঋণগ্রস্ত। শুধু সোহেলই নন, তার মতো অনেক প্রবাসীই ছুটিতে দেশে আসার পর আটকা পড়েছেন। তাদের কেউই এখনও যেতে পারেননি। ফলে কাজেও যোগদান করা হচ্ছে না তাদের। বেশিরভাগ প্রবাসীই প্রবাসের চাকরিও হারাতে বসেছেন। বিদেশ থেকে যে টাকা-পয়সা নিয়ে এসেছিলেন তাও এখন শেষ। বেশিরভাগ প্রবাস ফেরতরাই এখন ধারদেনা ও ঋণে জর্জরিত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক প্রবাস ফেরত ফারুক আহমেদ দুবাইয়ে একটি প্রসাধনীর দোকানে কাজ করতেন। প্রতি মাসে গ্রামের বাড়িতে ৫০ হাজার টাকা পাঠাতেন তিনি। কিন্তু গত ১৯ মার্চ দেশে আসার পর থেকে সেই আয়ও বন্ধ। ফারুক জানান, ছুটিতে আসার আগে তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। কারও কাছে কখনই কোনো টাকা ধার নিতেন না। কিন্তু এখন তাকে ধারের টাকায় চলতে হচ্ছে। তার মতে, এখন এমন একটা অবস্থা কারও কাছে সাহায্য চাইতে পারছেন না; আবার ভিক্ষাও চাইতে পারছেন না। অধিকাংশ প্রবাস ফেরত ব্যক্তিদের অবস্থা এখন ফারুকের মতো। নিরুপায় হয়ে তারা এখন ঋণ করে চলছেন। কেউ কেউ চড়া সুদেও ঋণ নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে আরেক প্রবাস ফেরত ব্যক্তি জানান, তিনি ১৬ বছর কাতারে ছিলেন। দেশে আসার পর অনেকের কাছে টাকা ধার চেয়েছেন কিন্তু কেউ দেয়নি। সাহায্য-সহযোগিতাও চেয়েছেন তাও কেউ করেনি। বাধ্য হয়ে তিনি তার দামি স্মার্টফোনটিও সম্প্রতি বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এখন এমন অবস্থা কাউকে বলতেও পারছি না, সইতেও পারছি না।
চলতি বছর করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশে ফেরত আসা প্রবাসীদের অধিকাংশই ভালো নেই। বেশিরভাগ প্রবাসীই তাদের জমানো টাকা ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। কেউ কেউ সেই টাকায় ছোট ব্যবসা শুরু করলেও আয় নেই। অনেকে সব হারিয়ে এখন ধারদেনায় চলছেন। কেউ কেউ আবার গ্রামে কড়া সুদে ঋণও নিচ্ছেন বিভিন্ন এনজিও থেকে। তবে এসব ঋণের টাকা তারা বিদেশ যাওয়ার পর পরিশোধ করবেন বলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও এনজিওর কাছ থেকে নিয়েছেন বলে জানিয়েছে বেশিরভাগ প্রবাসী।
বিদেশফেরত প্রবাসীরা জানিয়েছেন, তারা এখন বেকার সময় কাটাচ্ছেন। বেকারত্বের কারণে আপনও চিনছেন। যারা সব সময় পাশে ছিল, তারাও এখন খোঁজখবর নেন না। এক সময় দুহাতে টাকা কামাই করলেও অনেকে বাধ্য হয়ে এখন শ্রমিক ও রাজমিস্ত্রিরও কাজ করছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
সম্প্রতি প্রবাস ফেরতদের নিয়ে করা একটি জরিপের ফলাফলের ওপর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম প্রকাশিত ‘র্যাপিড অ্যাসেসমেন্ট অব নিডস অ্যান্ড ভালনারেবিলিটিস অব ইন্টারনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিটার্ন মাইগ্র্যান্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে বিদেশ ফেরতদের প্রায় ৭০ শতাংশই জীবিকাহীন। আর একেকজন অভিবাসী গড়ে তার পরিবারের তিনজন সদস্যকে সহায়তা প্রদান করে থাকেন। এ ছাড়াও করোনা মহামারির সময়ে দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশেরই এখন কোনো আয়ের উৎস নেই। ৫২ শতাংশ বলছেন, তাদের জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। কয়েক মাস আগে এমন একটি জরিপ চালিয়েছে ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগ।
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার সুকান্দের কাতার প্রবাসী শামসুল আলম দীর্ঘদিন ধরে কাতারে আছেন। ২ মার্চ করোনার কারণে দেশে ফিরেছেন। আর যেতে পারছেন না। ফলে বেকার বসে আছেন। কোনো আয়ও নেই তার সংসারে। সংসারে একমাত্র আয়ের ব্যক্তি হওয়ায় জমানো টাকাতেই চলছেন। এরই মধ্যে কিছু ধারদেনাও করেছেন। ভাবছেন ফ্লাইট চালু হবে, তিনি আবারও কাতার যাবেন। ঋণ পরিশোধ করবেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না।
শামসুল আলম বলেন, শুনেছি সরকার প্রবাস ফেরতদের ঋণ দিচ্ছে। সেই আশায় ব্যাংকে গেলাম কিন্তু তারা অনেক কাগজপত্র চায়। নিজের প্রতিষ্ঠানও দেখাতে হবে। আমার তো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, তাই পাঁচ লাখ টাকা ঋণের আবেদন করেও পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে এখন ধারদেনায় চলছি। একই দশা মালদ্বীপ ফেরত হবিগঞ্জের মাধবপুরের ছাতিয়ান গ্রামের রাসেদ মিয়ার। তিনি দেশে ফিরেছেন ৬ মার্চ। মালদ্বীপে একটি রিসোর্টে কাজ করতেন তিনি। দেশে আসার পর সংসার চালাতে তার সব জমানো টাকা খরচ করে ফেলেছেন। বাধ্য হয়ে এখন তিনিও ধারদেনায় চলছেন। তার ভাষ্য, সরকার একটু তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলে ভালো হতো।
করোনার কারণে গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফিরেছেন নিজাম উদ্দিন। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। ১৪ সদস্যের পরিবারে তার আয়েই সংসার চলে। কিন্তু এখন পুরোপুরি বেকার তিনি। নিজাম জানান, কোনোমতে সংসার চলছে। অপেক্ষায় আছেন কখন ফ্লাইট চালু হবে। চট্টগ্রামের জাহাঙ্গীর আলম সৌদি আরব থাকেন ১৬ বছর ধরে। গত ডিসেম্বরে তিনি চার মাসের ছুটিতে বাংলাদেশে আসেন। কোনো আয় নেই। তবে বাড়ির জমিজমা ও ধানী জমি থাকায় কষ্ট করেই চলছেন। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এখন অনেক কষ্টে আছি। বিমানের আশায় আছি, কখন বিমান চালু হবে। কোনো আয় রোজগার নেই, পুরোপুরি নিরুপায় হয়ে বসে আছি। ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান জানান, এই সঙ্কটময় সময়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশেষ করে যারা বিদেশে আছেন এবং যারা ফিরে আসছেন।