
কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গার ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এক প্রকার গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে বিরান ভূমিতে রূপ দিয়েছিল পৃথিবীর অন্যতম ‘হিংস্র’ এই সেনাবাহিনী। সেই ঘরহারা মানুষ এসে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। এরপর দেশটির সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। সেখানকার গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সাং সুচিকে জেলে পাঠান।
সেই ঘটনার পরই সাধারণ মানুষ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ শুরু করে। আর সেই বিদ্রোহ ধীরে ধীরে গোটা মিয়ানমারে ছড়িয়ে পড়ে। আর এই বিদ্রোহ দমন করতে বার্মি আর্মিও ‘কোমড় বেঁধে’ রাস্তায় নামে। ফিরে যায় তারা তাদের পুরাতন নৃশংসতায়। গুলি করে, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা শুরু করে।
আর এবার তো গোটা দুইটি গ্রাম সেই রাখাইনের মত পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে জান্তারা। মিয়ানমারে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ৮০০ বাড়িতে জান্তা সেনারা আগুন দিয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
সাম্প্রতিক সহিংসতার তীব্রতা এবং ব্যাপ্তি থেকে ধারণা করা হচ্ছে মিয়ানমারের সংঘাত এখন নাগরিক বিদ্রোহ থেকে সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে রুপ নিয়েছে।
সংঘাত মনিটরিং গ্রুপ ‘সশস্ত্র সংঘর্ষের অবস্থান এবং ইভেন্ট ডেটা প্রকল্প (Acled)’ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সহিংসতা এখন পুরো মিয়ানমারজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিন গ্রামের একজন বাসিন্দা গত শুক্রবার এএফপিকে বলেন, জান্তাবিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) যোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষের জের ধরে সোমবার সকালে তাদের গ্রামে সেনারা ফাঁকা গুলি ও গোলা ছুড়তে ছুড়তে গ্রামে প্রবেশ করে। গোলাগুলির শব্দ শুনে গ্রামবাসী ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় জান্তা সেনারা প্রায় ২০০ বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন।
নি বলেন, ‘সেনারা আমার বাড়িতেও আগুন দিয়েছে। পালানোর সময় সঙ্গে কিছুই আনতে পারিনি।’
এদিকে সেনারা ইন মা হতে গ্রামে প্রায় ৬০০ বাড়িতে আগুন দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন জান্তাবিরোধী স্থানীয় এক যোদ্ধা। নাম প্রকাশ না করে তিনি এএফপিকে বলেন, পিডিএফ যোদ্ধারা গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পরপরই সেনারা প্রবেশ করেন। তারা প্রায় ৬০০ বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন।
মিয়ানমারের প্রত্যন্ত এই দুই গ্রামের আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরের বেশ কিছু ছবি এএফপির হাতে এসেছে। তবে এসব ছবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় একজন অধিকারকর্মী নাম প্রকাশ না করে এএফপিকে বলেন, প্রত্যন্ত ওই দুই গ্রামের মানুষজন বেশ গরিব। পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর মেরামত করা তাদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন চ্যানেলের এক প্রতিবেদনে গত বৃহস্পতিবার ওই দুই গ্রামে আগুনে পোড়া বাড়িঘরের ছবি প্রচার করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পিডিএফের ‘সন্ত্রাসীরা’ এসব বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। শুক্রবার দেশটির সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর অনলাইন সংস্করণের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জান্তাবিরোধীদের শায়েস্তা করতে সেনাবাহিনী কয়েক শ বাড়িতে আগুন দিয়েছে বলে পিডিএফ জানিয়েছে। তবে ওই দাবি তারা নিরপেক্ষভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি বলে খবরে উল্লেখ করা হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা মঙ্গলবার জানিয়েছে, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী বছরব্যাপী বিক্ষোভ-প্রতিবাদে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে। এছাড়া দেশটিতে সশস্ত্র সংঘাতে আরও হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে একমত হয়েছেন যে, মিয়ানমারের সংঘাতকে এখন গৃহযুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করা উচিত এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর উপর চাপ দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ‘শক্তিশালী পদক্ষেপ’ নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন যে, মিয়ানমার সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া জোরালো ছিল না। মিয়ানমার পরিস্থিতিকে ‘বিপর্যয়কর’ আখ্যা দিয়ে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এই সংঘাত এখন মিয়ানমার ছাড়িয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
সামরিক সরকারের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা দলগুলো সম্মিলিতভাবে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) নামে পরিচিত। পিডিএফ হল বেসামরিক মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর একটি নেটওয়ার্ক। আর এই মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর সদস্য মূলত তরুণরা।
পিডিএফ সর্বস্তরের মানুষ- কৃষক, গৃহিণী, ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে তৈরি। সামরিক শাসন উৎখাতের দৃঢ় প্রত্যয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ।