
নকীব মাহমুদ, ঢাকা:
গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন যা মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে। কিন্তু এই গুম বা নিখোঁজের একটা বড় অংশই আর ফেরত আসেননি। তারা আদৌ বেঁচে আছেন কি মরে গেছেন তাও জানা যায়নি। তবে যারা ফিরেছেন তারা কেউই আর মুখ খোলেননি। এমনকি কি হয়েছিল সেইদিনগুলোতে তা নিয়ে কথা বলতে অনিহা প্রকাশ করেন। কিন্তু কেন ? তাদের উপর কি কোন ধরনের চাপ থাকে নাকি তারা ভয়ে কথা বলেন না?
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুয়ায়ী ৬০৪ জনের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে৷ ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোনো না কোনোভাবে ফিরে এসেছেন৷ অন্যরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন তার কোনো তথ্য নাই পরিবারের কাছে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও কোনো তথ্য দিতে পারছে না৷
সম্প্রতি ১০ দিন নিখোঁজ ছিলেন ইসলামী বক্তা ত্ব-হা আদনান। তিনি শুক্রবার বাসায় ফিরেছেন। পুলিশের দাবি তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তবে এ নিয়ে এখনো মুখ খোলেনি ত্ব-হার পরিবার ও দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রশ্ন হলো-ত্ব-হা যদি সত্যিই আত্মগোপনে গিয়েছিলেন তাহলে কেন মিডিয়ার সামনে কথা বলছেন না। তার কেনই পুলিশ দাবি করছে, তিনি আত্মগোপনে গিয়েছিলেন।
আসক বলছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে বিভিন্ন সময়ে ওইসব ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে৷ পরিচিত কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ অথবা আলোচনা বা আলোড়ন সৃষ্টি না হলে খুব কমই উদ্ধারের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়৷
২০১৬ সালের ১৬ মার্চ সংসদ ভবনের সামনের রাস্তা থেকে অপহরণ করা হয় আইটি বিশেষজ্ঞ তানভীর জোহাকে। তিনি উদ্ধার হন ৭ দিন পর ২৩ মার্চ রাতে। তিনি একটি বিদেশী গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আমাকেও হাত-পা ও চোখ বেঁধে অপহরণ করা হয়। সেভাবেই রাখা হয়। পরে আমাকে বিমানবন্দর এলাকায় পাওয়া যায়। আমি সেখানে উদভ্রান্তের মত ঘুরছিলাম। তিনি বলেন, এই নিয়ে পরে আর তদন্ত হয়নি। আমাকে কথা বলতেও নিষেধ করা হয়। কারা নিয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারছি, কিন্তু বলতে পারছি না।
সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুকে পল্লবী এলাকায় তার ভাইয়ের বাসা থেকে অপরহণ করা হয় ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে৷ তার বোন রেহনা বানু মুন্নি জানান, তাকে সাদা পোশাকে অস্ত্রধারীরা সরকারি লোক পরিচয়ে ধরে নিয়ে যায়৷ এরপর সে আর ফিরে আসেনি৷ আমরা তখন থানায় জিডি করেছি৷ থানা মামলা নেয়নি৷ পরে আদালতে মামলা করেছি৷ মামলার তদন্ত শেষে পল্লবী থানা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে৷ তারা বলেছে ওই নামে একজন নিখোঁজ হয়েছেন সত্য, কিন্তু এর বেশি আর কোনো তথ্য তদন্তে পাওয়া যায়নি। যতদিন বেঁচে থাকব আমার ভাইকে আমি ফেরত চাইব৷
ক্যানাডার ম্যাগগিল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ইশরাক আহমেদ ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট রাত সাড়ে ৮ টার দিকে ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে নিখোঁজ হন৷ তিনি কোরবানির ঈদ করতে ঢাকায় এসেছিলেন৷ ওই এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে তাকে অপহরণের বিষয়টি নিশ্চত হওয়া যায়৷ কিন্তু এত দিনেও তার কোনো খোঁজ দিতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷
ইশরাতের বাবা জামাল আহমেদ জানান, তার ছেলে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না৷ কোনো অপরাধের ঘটনার সঙ্গেও জড়িত ছিল না৷ ম্যাগগিল ইউনিভার্সিটিতে মাত্র প্রথম সেমিস্টার শেষ করেছিলেন তিনি৷ তারপরই দেশে এসে নিখোঁজ হয়ে যান। জামাল আহমেদ এখনও জানেন না তার ছেলেকে কারা নিয়ে গেল।
২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর মারুফ জামান নিজ বাড়ি থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন। প্রায় ১৫ মাস নিখোঁজ থাকার পর নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। তবে তিনি কোথায় কি অবস্থায় ছিলেন এবং ফিরলেন কিভাবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি। পরে জামানের মেয়ে তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বাবার ফিরে আসার খবরটি নিশ্চিত করলেও এ বিষয়ে আর কিছু জানতে না চাওয়ার অনুরোধ করেন।
তারও চার বছর আগে জাতীয় নির্বাচনের সময় আরো কয়েকজনের সঙ্গে নিখোঁজ হয়েছিলেন সাজেদুল ইসলাম নামে বিএনপির এক সংগঠক। হাইকোর্টের রুল জারি সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ভাইয়ের সন্ধানে কোন অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভ জানান নিখোঁজের বোন সানজিদা ইসলাম। তিনি একটি গণমাধ্যমকে জানান, আমরাও ভাইয়ের সন্ধানের দাবিতে অনেক সংবাদ সম্মেলন করেছি। মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে তারা দেখবেন। কিন্তু তারা কোন তদন্ত করেনি।
২০১০ সালে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সাবেক ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চৌধুরী আলম গুম হন। পরের বছরগুলোও রাজনৈতিক নেতাদের গুম হওয়ার বিষয়টি অব্যাহত থাকে। ২০১২ সালে গুম হন বিএনপির সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলী। এখনো নিখোঁজ আছেন যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আজমি ও যুদ্ধাপরাধের দায়ের ফাঁসি হওয়া জামায়াত নেতা মীর কাশিম আলীর ছেলে মীর আহমেদ বিন কাশিম।
বাংলাদেশের একটি মানবাধিকার সংগঠন বলছে, গত ১১ বছরে মোট ৫৮৭ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। দেশটিতে রাজনৈতিক নেতাদের নিখোঁজ হওয়ার পর পর কয়েকটি ঘটনা তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু এখন সাধারণ ব্যক্তিরাও গুম হচ্ছেন বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকার-বিরোধী মনোভাব নির্মূল করা এবং তাদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে গুমকে এখন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তারা বলছে।
২০১৯ সালের জুন মাসে নিজের কর্মস্থল থেকে নিখোঁজ হন ইসমাইল হোসেন বাতেন। কাঠের ব্যবসায়ী বাতেন মিরপুরে তার কাজের জায়গা থেকে দুপুরের পর থেকে নিখোঁজ হন। বাতেনের স্ত্রী নাসরিন জাহান বলছেন যে সময়ে তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন সেই সময় কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য তিনি ছিলেন না, তবে তিনি বলেন তার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত নানা ভাবে চেষ্টা করেছেন তার খোঁজ বের করতে কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
তবে গুমের শিকার হওয়া কিংবা অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে আসা মানুষের তালিকায় এখন আর শুধু রাজনৈতিক নেতারা নন, আছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবী, সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিরাও। পরিবারগুলো আছেন তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায়।
মানবাধিকার কর্মী এবং আসক-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, যারা ফিরে এসেছেন তাদের কয়েকজনের সাথে আমি কথা বলতে পেরেছি৷ তাদের ভাষ্য মতে অপহরণের পর তাদের গোপন জায়গায় বন্দি রাখা হয়৷ পাহারায় যারা থাকেন তারা প্রশিক্ষিত৷ আর অপহরণ করা হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে৷
অপহরণকারীরাও প্রশিক্ষিত৷ তাদের শারীরিক গঠনই বলে দেয় তারা পেশাদার৷
তিনি বলেন, এই নিখোঁজ হওয়াদের কাউকে কাউকে কয়েক মাস পরও গ্রেপ্তার দেখানোর নজির আছে৷ নিখোঁজ ও গুম নিয়ে যা একটি বড় প্রশ্নের জন্ম দেয়৷
নূর খানের মতে, যারা নিখোঁজ বা গুম হন তাদের একটি অংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ক্ষমতাসীন দলের লোকও এর শিকার হয়েছেন৷ যাদের নামে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আছে এরকম ব্যক্তিরাও গুমের শিকার হয়েছেন৷
নিখোঁজ বা গুমের শিকার যারা হন তাদের পরিবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোনো সহযোগিতা পায় না৷ উল্টো হয়রানির শিকার হন বলেও অভিযোগ আছে৷ নূর খান বলেন, ‘‘এর মাধ্যমে সমাজে একটি ভয়ার্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে৷
এনিয়ে চেষ্টা করেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি৷ আর পুলিশ সদর দপ্তর কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি৷
গুম ঠেকাতে কী প্রয়োজন?
তবে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ফিরে আসা প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাগুলো সামনে আনা জরুরি বলে মনে করেন মানবাধিকার-কর্মী সুলতানা কামাল।
যেসব আশঙ্কা ও হুমকির কারণে এই মানুষগুলো মুখ খুলতে ভয় পান সেই ভয় দূর করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর আরও জোরালো ভূমিকা নেয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
সুলতানা কামাল বলেন, এর আগে যারা হারিয়ে গিয়েছিলেন, পরে ফিরে এসেছেন, তাদের কাছে আমরা প্রশ্ন রেখেছিলাম, তার মধ্যে একটি উত্তর এমন ছিল যে, ছেলেমেয়ের ওপর যখন হুমকি আসে তখন মুখ খোলা কঠিন। তার মানে নিশ্চয়ই তাদেরকে এমনই কোন শর্ত দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। যার জন্য তারা মুখ খুলতে ভয় পান।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনের অভিযোগ, তারা প্রিয়জনের খোঁজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করলেও এখনও কোনটির তদন্ত শুরু করা হয়নি। এমন অবস্থায় প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে পরিবারগুলোকে।