
নকীব মাহমুদ, ঢাকা
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কর্ণগোপ এলাকার সেজান জুসের কারখানাটি তৈরিতে মালিক এমএ হাসেম কোন
অনুমতি নেননি। এমনকি কোন দফতরের অনুমতিও ছিল না। তবে বিষয়টি এতদিন প্রকাশ না হলেও সম্প্রতি তা
প্রকাশ পেয়ে যায়। প্রশ্ন উঠেছে, এত অনিয়মের মধ্যে ২০০০ সাল থেকে কীভাবে কারখানাটি পরিচালনা করে
আসছিল হাসেম ফুড কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলো কি এর দায় এড়াতে পারে।
ভবনে কেমিক্যাল গুদাম থাকলেও ছিল না বিস্ফোরক পরিদফতরের লাইসেন্স। ভবনটি নির্মাণের ক্ষেত্রে
বিল্ডিং কোডের নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। কেমিক্যালের গোডাউন ব্যবহার করতে নকশাও
অনুমোদন করে নেয়নি হাসেম ফুডস কর্তৃপক্ষ। কলকারখানা অধিদফতরের লাইসেন্স নিলেও সেটি নবায়ন করা
হয়নি। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর থেকেও ছাড়পত্র নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্ট
দফতরগুলোতে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, কারখানাটিতে পর্যাপ্ত ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা ছিল না, ইমার্জেন্সি এক্সিটের
ব্যবস্থা ছিল না এবং ভবনে অনুমোদিত ফ্লোর সাইজ যা থাকার কথা ছিল তার চেয়েও বড় সাইজের ফ্লোর করে তা
ব্যবহার করা হচ্ছিল। হাসেম ফুড কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে বড় আরেকটি অপরাধ করেছে কারখানাটিতে শিশুশ্রমিক
নিয়োগ দিয়ে। বাংলাদেশের শ্রম আইনে কোনো শিল্প-কারখানায় শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ এবং
এটি দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ কারখানাটির মালিক-কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর শিশুশ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়েছে।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.)
আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ বলেন, কলকারখানা অধিদফতরের লাইসেন্স যদি নবায়ন না করা হয়, কিংবা
বিস্ফোরক অধিদফতরের লাইসেন্স না নিয়ে যদি কারখানা মালিক এতদিন তার কারখানা চালিয়ে আসেন, তা হলে
সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো কী করেছে। ওই দফতরগুলোর তো নিয়মিত কারখানা পরিদর্শন করার কথা। এই যে
আগুনের ঘটনায় ৫২ জন শ্রমিকের জীবন চলে গেল, তার দায় কারখানা মালিকের পাশাপাশি এসব দফতরের ওপরও
বর্তায়।

এ বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বলেন, হাসেম ফুড কর্তৃপক্ষকে
কেমিক্যাল গোডাউনের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। অনুমতি ছাড়া বিস্ফোরক পদার্থ নিজেদের মতো করে
গোডাউনে রাখায় আইন অনুযায়ী শাস্তি হবে। তবে এখন যেহেতু বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি হয়ছে, সেহেতু এখনই
সবকিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরদর্শন অধিদফতরের নারায়ণগঞ্জের উপমহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া বলেন,
প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সালে লাইসেন্স নিলেও পরে আর নবায়ন করেনি। এতদিন অবৈধভাবেই তারা কারখানা
পরিচালনা করে আসছিল। এখন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতদিন বিষয়টি আপনাদের
নজরে আসেনি কেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারখানায় পরিদর্শনে গেলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে
আমাদের সঠিকভাবে সহযোগিতা করা হয়নি।ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের উপপরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, তারা আামাদের বলেছিল ৬ মাসের মধ্যে ফায়ার সেফটি প্ল্যান করে জমা দেবে, কিন্তু ৯ মাস পার হয়ে গেলেও সেটি তারা দেয়নি। এতদিন তারা অবৈধভাবেই কারখানাটি চালিয়ে আসছিল।
আরও আগেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল। আমরা তাদের নোটিস দিয়েছি কয়েকটি, কিন্তু তারা এর কোনো জবাব দেয়নি। আগে থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হয়তো এতগুলো প্রাণ আগুনে পুড়ত না।
জানা গেছে, ছয়তলা ভবনটি তৈরির সময় বিল্ডিং কোড বা ইমারতবিধি মানা হয়নি। এমনকি সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে
অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। বিশাল ভবনে প্রতিটি তলার সিঁড়ি ছিল লোহার জালে ঘেরা এবং তালাবদ্ধ। এ কারণে
কর্মঘণ্টা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই সিঁড়ি দিয়ে কখনই নামতে পারত না শ্রমিকরা। বিশাল এই ভবনে ছিল না
কোনো ফায়ার এক্সিট বা ইমার্জেন্সি এক্সিট (জরুরি নির্গমনপথ)। ইমার্জেন্সি এক্সিট বা বিকল্প সিঁড়ির
ব্যবস্থা না থাকলে ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি দেওয়ার কোনো বিধান নেই।
ভবনটিতে ছিল না কোনো ফায়ার অ্যালার্ম, হাইড্রেন্ট সিস্টেমের মতো পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম।
বিশাল বিশাল ফ্লোরে (তলা) নামমাত্র দুই থেকে তিনটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকলেও সেগুলোর ব্যবহারের
নিয়ম কখনও শেখানো হয়নি শ্রমিকদের। অথচ হাসেম ফুডের মতো বিশাল কারখানায় যেখানে ৭ হাজার শ্রমিক
কাজ করত, সেখানে প্রতিবছর অগ্নিমহড়া হওয়ার কথা ছিল। তবে তাও হয়নি।