
লালমনিরহাট ও নীলফামারীর মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা আবারও ভয়াল রুপ নিচ্ছে। দেশে অবিরাম বৃষ্টি আর সীমান্তের ওপারে উজানের ঢল নেমে আসায় তিস্তা নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতোমধ্যে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। নদ-নদীর পানি আকস্মিকভাবে বৃদ্ধির ফলে চরাঞ্চলে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। বন্যার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তিস্তার ৬৩টি চরের মানুষ।
রোববার (২০ জুন) সন্ধ্যা ৬টায় হাতিবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ৫২.৪৫ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচে ছিল। স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ৫২.৬০ সেন্টিমিটার।
জানা গেছে, গত ১০ দিনে তিস্তার ভাঙনে ৩০টি পরিবারের বাড়িঘর নদীতে বিলিন হয়েছে। আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের কুটিরপাড় এলাকার বালুর বাঁধ, সদর উপজেলার গোকুণ্ডা, ইউনিয়নের ভাঙন বেড়েই চলছে। সেখানে বসবাসরত মানুষ আতঙ্কে দিন যাপন করছে।
নীলফামারী ও লালমনিরহাটের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা আতঙ্কে আছেন। কারণ তিস্তায় পানি বাড়ছে। সেই সঙ্গে আজ ৪৪ টি গেট একই সাথে খুলে দেওয়া হয়েছে। গেট খুলে দেওয়া মানেই হলো পানি বেড়েছে। তা এখন পুরো দুই জেলার মানুষকে ভোগাবে। কিন্তু তারা এই কথা কার কাছে বলবেন বলে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।
তারা আরও বলেন, আমরা খরা মৌসুমী কোন পানিই পাই না। কিন্তু বর্ষা মৌসুমী পানিতে ডুবে মরি। যখন পানির দরকার হয় তখন পানি না দিয়ে ভারত আমাদের সাথে বেইমানি করছে। আমাদের ন্যায্যটাও তারা দেয় না।
নীলফামারীর দইখাওয়া গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা রফিকুল জানান, তারা প্রতি বছর তিস্তার পানিতে বিপদে পড়েন। বিশেষ করে বন্যার সময় তাদের কোন ফলস তারা ঘরে তুলতে পারেননি। প্রতি বছর বন্যা সব শেষ করে দেয়। এবারও তারা চিন্তা আছেন।
লালমনিরহাটের হাতিবান্দার বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, তিস্তা আমাদের জন্য এখনো আর্শিবাদ হয়ে আসেনি। বর্ষা আসলেই আমরা ভয়ে থাকি। কখন জানি পানি প্লাবিত হয়ে ঘরে আসে।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় স্থানীয়দের সহায়তায় গড়া বালুর বাঁধের অর্ধকিলোমিটার মাত্র দুই দিনের ভাঙনে তিস্তা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী মরুভূমিতে পরিণত হলেও বর্ষার শুরুতে উজানের ঢলে ফুলে-ফেঁপে উঠে হিংস্র রূপ ধারণ করে তিস্তা নদী। প্রতিবছর তীর ভেঙে বসতভিটা ও ফসলি জমি হারিয়ে পথে বসছে তিস্তাপারের হাজারো পরিবার। জন্মলগ্ন থেকে তিস্তা নদী খনন না করায় সামান্য পানিতে দুই কূল উপচে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে। চরম দুর্ভোগে পড়ে তিস্তাপারের মানুষ। দুর্ভোগ লাঘবে নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
কুটিরপাড় এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গ্রামবাসী সহায়তা করে বালুর বাঁধটি নির্মাণ করা হয়। বাঁধটি হওয়ায় আশা করেছি এ বছর আর নদীভাঙনের মুখে পড়তে হবে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করতে পারব। কিন্তু বর্ষার শুরুতে পানির চাপে দুই দিনের ব্যবধানে বালুর বাঁধটি বেশির ভাগ অংশই বিলীন হয়েছে।
তিনি বলেন, বাঁধটি বিলীন হলে আমার বাড়ি নদীর মুখে পড়ে। তাই বাধ্য হয়ে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছি। দুই আগেও যেখানে আমি ঘুমাতাম। আজ সেখানে নদীর স্রোত বইছে। বাকি অংশটুকু রক্ষা করা সম্ভব না হলে বর্ষার আগে কুটিরপাড়, চৌরাহা ও বাদিয়ারটারী বিলীন হতে পারে।
ভাঙন এলাকা পরিদর্শন শেষে আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন বলেন, বালুর বাঁধটির অর্ধের বেশি বিলীন হয়েছে। বাকিটুকু রক্ষা করতে জিও ব্যাগ প্রয়োজন। যার চাহিদা পাঠাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। অনেক বাড়ি নদীভাঙনের মুখে পড়েছে। তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ভাঙনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। নির্দেশনা পেলে ভাঙন রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তিস্তার পানি বৃদ্ধি সম্পর্কে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) আব্দুল আল মামুন গণমাধ্যমকে বলেন, উজানের ঢল ও বৃষ্টির কারণে তিস্তা নদীতে হু হু করে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেলে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় তিস্তার পানি বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
পাটগ্রামের দহগ্রাম; হাতিবান্ধার গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, ডাউয়াবাড়ী; কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী; আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী; সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুণ্ডা, ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করতে পারে যে কোনো সময়।